আমাদের সমাজে সমকামীদের অস্তিত্ব নতুন কিছু নয়। হ্যা, এটা ঠিক যে বিশাল একটা সময় ধরে সমকামীদের আত্মগোপন করে রাখতে হয়েছে নিজেদের যৌন প্রবৃত্তিকে। কেউ কোনভাবে প্রকাশিত হয়ে গেলে পেতে হয়েছে নির্মম শাস্তি।
আমাদের পরিচিত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকেই শাস্তি পেতে হয়েছে নিজের যৌন প্রবৃত্তির কারণে। দীর্ঘ সময় ধরে সমকামীদের শুনতে হয়েছে নানা বাজে তকমা। এখন আস্তে আস্তে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হচ্ছে। ফলে সমস্ত যৌন সংখ্যালঘু মানুষরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে। এই জানান দিতে গিয়ে সেকেলে চিন্তাধার কিছু বিরুদ্ধবাদীদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আজকাল সমকামিতা নিয়ে যারা সামন্যতম পড়াশুনা করেছেন তাদের মুখে সমকামীরা বিকৃত মস্তিস্কের, আধুনিকতার তৈরী, প্রকৃতি বিরুদ্ধ, প্রাণী জগতে সমকামিতা নেই, এ’রকম মন্তব্যগুলো আর তেমন শোনা যায় না। কারণ সমকামীরা যে সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক এ নিয়ে অনেক গবেষণার প্রতিবেদন বের হয়েছে – সমকামিতা যে আধুনিক যুগের তৈরি নয় বরং মানব জাতির উদ্ভবের ঊষালগ্ন থেকেই ছিল তা নিয়ে ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে, প্রকৃতি সমকামীদের কিভাবে টিকিয়ে রাখছে তা আজ স্পষ্ট।
প্রাণী জগতে যে সমকামিতা ছড়িয়ে আছে তা নিয়ে অনেক প্রামাণ্যচিত্র তৈরী হয়ে আছে। সমকামবিদ্বেষীদের কাছে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি বিষয় হচ্ছে সমকামী যৌনতায় বাচ্চা উৎপাদন হয় না। বিজ্ঞান তাদের এই মাথা ব্যাথার জবাব দিতেও প্রস্তত। কিন্তু যারা যৌনতার উদ্দেশ্যকে শুধু মাত্র বাচ্চা উৎপাদন হিসেবে চিহ্নিত করেন তারা নিজেরাই কেন সেই উদ্দেশ্যকে লঙ্ঘন করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষধ এবং কন্ডম ব্যবহার করতে ব্যস্ত তা আমার বোধগম্য নয়। বরং তাদের উচিৎ ছিল বছর বছর বাচ্চা জন্ম দিয়ে উদ্দেশ্যকে সফল করা। এদের যুক্তি মানতে হলে বিষমকামী দম্পতিদের মধ্যে যারা বন্ধ্যা, তাদেরকে ফাঁসি দিতে হবে, বাচ্চা জন্মদানের বয়স শেষ হলে আর যৌনতা করা যাবে না । কিন্তু শুধু মাত্র সমকামীদের ক্ষেত্রেই তাদের দ্বিচারিতা তাদের নৈতিক আদর্শকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সমকামবিদ্বেষীদের এত সব বাহানার জবাব দেয়ার পরও কেন সমকামীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নত করা হবে? কেন তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে?
অপরাধ এবং স্বাধীনতার ধারণা নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে ভয়াবহ ধরণের অজ্ঞতা। আর এই অজ্ঞতার কারণে আজও এদের মুখে শুনতে হয় “সমকামীদের স্বাধীনতা দিলে চোর-ডাকাতকেও স্বাধীনতা দিতে হবে” জাতীয় আজগুবি কথাবার্তা। দেশ অনুযায়ী অপরাধের ধারণা ভিন্ন হলেও একটি মৌলিক বিষয়ে সকলে একমত যে অপরাধ হিসেবে সেই কাজটাকে চিহ্নিত করা হবে যে কাজটা কর্তা এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকর। এই ধারণা মতে চোর-ডাকাত অন্যের ক্ষতি করছে এজন্য এটি অপরাধ। কিন্তু একজন ব্যক্তি কাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলে সুখী হবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে তার নিজের ক্ষতিও হচ্ছে না, অপর কারও ক্ষতিও হচ্ছে না। বরং কেউ যদি একজন ব্যক্তির ব্যক্তি জীবনে হস্তক্ষেপ করে তাকে হেনস্তা করে, সেটাই অপরাধ। এই হিসেবে সমকামবিদ্বেষ একটি অপরাধ।
সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এটা বিবেচ্য বিষয় হবে যে এতে কি দু’জন ব্যক্তিই সম্মত এবং অপর কারও সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে কি না। এই হিসেবে পশুকামিতা অপরাধ হতে পারে, শিশুকামিতা অপরাধ হতে পারে। কারণ পশু এবং শিশু সম্মতি দিতে অক্ষম। আবার একজন শিশু সম্মতি দিলেও সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মতামত দেয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়স হওয়া প্রয়োজন।
দু’জন ব্যক্তি কারও কোন ক্ষতি না করে নিজেদের ভাল থাকার জন্য সমলিঙ্গের কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলে সেটা অপরাধ হয় কি করে? এখন হয়তো ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে আনা হবে। ধর্ম এটাকে পাপ বা অপরাধ বলেছে। আচ্ছা এক ধর্ম তো অন্য ধর্ম পালন করাকে পাপ বলেছে, অন্য ধর্মের মানুষদের পাপী বলেছে। তা এখন কি করবেন? অন্য ধর্মকে পালন নিষিদ্ধ করবেন? অন্য ধর্মের মানুষদেরকে হত্যার আইন করবেন? আপনার ধর্মের বিধান তাদের উপরে চাপিয়ে দিয়ে পালন করতে বাধ্য করবেন?
যদি না করেন তাহলে আপনার এই পাপ বোধের ধারণা কেন শুধু সমকামীদের উপরে চাপিয়ে দিবেন? আপনার ধর্মে পাপ বলেছে তো আপনি করবেন না, ব্যাস ঝামেলা মিটে গেল। আপনাকে কেউ বাধ্য করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু আপনার কোন রকম ক্ষতি না করার পরও কেন আপনি শুধু আপনার বিশ্বাস পালনের জন্য দু’জন মানুষের ব্যক্তি জীবনে ঢুকে পড়বেন?
এবার স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনার দিকে আসি। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করবো।
অপরাধ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ আপনি সেই ব্যক্তিস্বাধীনতাটাই ভোগ করতে পারবেন যেটা অপরাধ নয়। একজন চোর, ডাকাত বা খুনির কাজ হচ্ছে অপরাধমূলক। তার এই অপরাধমূলক কাজগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়। কিন্তু সমকাম এ’রকম কিছু নয় বরং নিজেদের মধ্যেকার যৌন প্রবৃত্তি। অতএব নিজেদের যৌন প্রবৃত্তি চারিতার্থ করার অধিকার দু’জন ব্যক্তির আছে। এর পরেও যারা সমকামিতা এবং চুরি ডাকাতিকে গুলিয়ে ফেলেন তাদেরকে আমি সবচেয়ে অজ্ঞ শ্রেণীর বলেই মনে করি।
সমকামীরা যেহেতু মানুষ তাই তাদেরও যৌন প্রবৃত্তি আছে। শুধু পার্থক্য এটাই যে বিষমকামীদের আকর্ষণ বিপরীত লিঙ্গের দিকে আর সমকামীদের আকর্ষণ সমলিঙ্গের দিকে। এই সমলৈঙ্গিক আকর্ষণ একজন সমকামী ব্যক্তি নিজে তৈরী করেনি, যেমনটা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বিষমকামীরা নিজেরা তৈরী করেনি।
এই আকর্ষণবোধ তৈরী করে শরীরবৃত্তিয় কিছু বৈশিষ্ট। একজন বিষমকামী থেকে একজন সমকামীর এই বৈশিষ্টগুলো (মস্তিস্কের গঠন, জেনেটিক প্যাটার্ন, হাইফোথেলমাস, হরমোনের ভিন্নতা) আদালা হওয়ার কারণে এই আকর্ষণটা সমলিঙ্গের দিকে যায়।
একজন বিষমকামী ব্যক্তি তার আকর্ষণ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি হওয়াতে বিপরীত লিঙ্গের সাথে যৌনতার স্বাধীনতা পেলে, সমকামীরা তাদের আকর্ষণ সমলিঙ্গের প্রতি হওয়াতে সমলিঙ্গের সাথে যৌনতা করতে পারবে না কেন? একজন বিষমকামী ব্যক্তিকে সমলিঙ্গের সাথে বিবাহ দিয়ে সমকামিতা করালে যতটা কষ্ট পাবে ঠিক একজন সমকামী ব্যক্তিকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে বিবাহ দিয়ে বিষমকামিতা করালে ততটাই কষ্ট পাবে।
পরিশেষে বলব অপরকে বিচার করার আগে সেই বিচারটা নিজের উপরে করুন। তারপর যদি মনে হয় এই বিচারটা আপনার প্রতি ন্যায় হয়েছে তবেই সেটা অপরের প্রতি প্রয়োগ করুন।