LGBT NEWSNEWSএকান্ত ভাবনাএলজিবিটিএলজিবিটি সংবাদধর্মীয় ভাবনা

Dead sea, a horrible myth

‘ডেড সি! এক ভয়ঙ্কর মিথ’

ডেড সি ( মৃত্য সাগর বা লূত সাগর) ইহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্মে একটি বিশাল স্থান দখল করে আছে। ডেড সি বা লূত সাগর নিয়ে ধর্ম গ্রন্থগুলোতে রয়েছে নানা কল্প কাহিনী। বিভিন্ন নদী, বিভিন্ন স্থান ও নানা জিনিস নিয়ে এরকম কল্পকাহিনী প্রচলিত থাকে। এগুলোকে আমরা মিথ বলি। অনেকেই তাদের আশে-পাশের নানা জিনিস নিয়ে এরকম প্রচলিত মিথ শুনে থাকতে পারেন। কেউ হয়ত এসব মিথ অন্ধভাবে বিশ্বাস করে আবার কেউ যুক্তি প্রমাণ না থাকায় এসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ওসব ছোট ছোট মিথে বিশ্বাস অবিশ্বাস হয়ত তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু ডেড সি বা লূত সাগর এমন একটি মিথ যা যুগের পর যুগ ধরে সমাজে গভীব প্রভাব ফেলতে পেরেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত প্রায় সবাই ডেড সি বলতে এক ভয়ঙ্কর ভূতুরে স্থান হিসেবে কল্পনা করতেই ভালবাসে।

বিশেষ করে সমকামিতার প্রসঙ্গ উঠলে এই লূত সাগরের প্রসঙ্গ যে উঠবে না এমনটা আজ-কাল চিন্তা করাও যায় না। ইন্টারনেটে সমকামী বিদ্বেষীদের তৈরী করা লূত সাগরের ডিজাইন দেখলে গাঁ ছমছম করে ওঠে। তাদের ধারণা এই ডেড সি সমকামীদের প্রতি ঈশ্বরের পাঠানো গযব থেকে তৈরী হয়েছে। ধর্ম গ্রন্থগুলোর দাবি করে ফেরেশতা কর্তৃক উক্ত স্থান উল্টে দেয়া, অগ্নি বৃষ্টি হওয়া, আঁকাশ থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ হওয়ার ফলে এই সাগরের তৈরী হয়েছে। ঈশ্বর বা আল্লাহর অভিশাপের কারণেই নাকি এই সাগরে কোন জীব বাঁচেনা। কিন্তু আসলেই কি এটি ঐশ্বরিক গযবে সৃষ্ট কোন স্থান? ডেড সি কি আসলেই অমঙ্গলজনক ভয়ঙ্কর কোন ভূতুরে স্থান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে খুঁজে বের করা তেমন কঠিন কিছু নয়। ডেড সি সৃষ্টি হওয়ার প্রকৃত কারণ এবং এসব উদ্ভট মিথগুলোর দাবিগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে ধর্মগ্রন্থগুলোর ওসব কল্পকাহিনী ধোপে টিকবে না।

আব্রাহামিক ধর্মগুলো থেকে জানা যায় লূত ছিল ইব্রাহিমের ভাতিজা। এই লূতের সময়েই নাকি সমকামীদের প্রতি গযব স্বরুপ ডেড সি তৈরী হয়। কিছু ইসলামিক ও ঈস্রাইলী বর্ণনা এবং উইকিপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায় ইব্রাহিমের জন্ম ১৮০০ থেকে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। মুহাম্মাদ সালামাহ জাবর কর্তৃক লিখিত তারীখুল আম্বিয়া গ্রন্থ থেকে জানা যায় ঈসা এর জন্মের দু’হাজার বছর আগে ছিল ইউসুফ এর সময়কাল আর ইউসুফ হচ্ছে ইব্রাহিমের তৃতীয় অধ্বতন পুরুষ অর্থ্যাৎ ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক,তার পুত্র ইয়াকুব,তার পুত্র ইউসুফ। আর ইউসুফের প্রপিতা ইসহাকের চাচাত ভাই হচ্ছে লুত। সেই হিসেবে একেকজনের গড় বয়স ১৫০ বছর করে ধরলেও ৪৫০ বছর হয়। তাহলে এই তথ্য মতেও ঈসার সময় থেকে লূত এর সময় হচ্ছে (২০০০+৪৫০) = ২৪৫০ বছর পূর্বে। অর্থ্যাৎ আজ থেকে প্রায় ৪৪৬৯ বছর পূর্বে ডেড সি তৈরী হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস ও বিজ্ঞান ভিন্ন কথা বলে। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ও উইকিপিডিয় থেকে ডেড সি সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরি।

“প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্দান নদী , মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল । প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।

৭০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সি’র পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল। ২৬,০০০ বছর পূর্বে এটির পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে। প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা নাটকীয় ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে, যা সম্ভবত বর্তমান পৃষ্ঠ উচ্চতার চাইতেও কম ছিল। গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশেপাশে অবস্থান করছে।বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , মহাসাগরের পানির তুলনায় ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর পার্থক্য আছে । মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড , ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড , ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে । এর লবণাক্ততা শতকরা ৩০% । ফলে পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার ।উচ্চ প্লবতার দরুন যে কেউ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে । এই আচরণ যুক্তরাষ্ট্র-এর ইউটাহ তে অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেক এর মতো “। কোথায় তিন মিলিয়ন বছর আর কোথায় মাত্র ৪৪৬৯ বছর। ডেড সি নিয়ে ধর্মের এই গোঁজামিল দেখেই বোঝা যায় ধর্ম গ্রন্থের লূতের কাহিনী সম্পর্ণ ভিত্তিহীন।

এবার দেখে নেই ডেড সি সত্যিই অমঙ্গলজনক ভয়ঙ্কর ভূতুরে কোন স্থান? না একেবারেই নয়। বরং মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে । এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা , উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি । উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় চাপ , শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। চর্মরোগ সোরিয়াসিস( psoriasis) এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী । এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে । এছাড়া রোগটি নিরাময়ে জন্য মৃত সাগরের লবণও বেশ উপকারী বলে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় দাবী করা হয়েছে।

এই স্থান এতটা উপকারী হওয়ার পরেও কেন পানিতে জীব নেই? এটাও জানা দরকার। হ্যা, মৃত সাগরে কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই বা কোন প্রাণী বাঁচে না। কথাটা আংশিক সত্য। অতিমাত্রায় লবণ থাকার কারণে মৃত সাগরে কোন মাছ বা অন্যান্য জীবজন্তু টিকতে পারে না। এমনকি মানুষরাও এই সাগরে ডুবসাঁতার দিতে গিয়ে পানি খেয়ে ফেললে শ্বাস আটকে মারা যেতে পারে। তবে গত তিন-চার বছরে গভীর তলদেশে ডাইভ করে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু ব্যাক্টেরিয়ার পুরু স্তর পেয়েছেন। এছাড়াও পাওয়া গেছে অণুজীবের কলোনি। এর কারণ মৃত সাগরের তলদেশে কিছু ছোট ছোট স্বাদুপানির “ফোয়ারা” বা জেটস্ট্রিম আছে। ব্যস, স্বাদুপানি যতখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে লবণক্ততা কম। জায়গাগুলো প্রায় ৩৩ ফুট চওড়া ও ৪৩ ফুট গভীর। এরকম বেশ কিছু স্পটে একই রকমের ব্যাকটেরিয়ার প্রাচুর্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

সুতরাং এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে মৃত সাগরের অতিমাত্রায় লবণই প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর, আর যেখানে লবণের পরিমাণ কম, সেখানে প্রাণ জন্মাতে সময় লাগে নি। এর সাথে কোনো অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার জড়িত না। পৃথিবীতে এ রকম হ্রদ আরও অনেক গুলো আছে। ডেড সি নিয়ে প্রচলিত মিথ তৈরী হয়েছিল সম্ভাবত বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখার সময়কালে। আর বর্তমানে বাইবেলের তথ্যমতে ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হয় ১৪৪৫ -১৪০৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। অর্থ্যাৎ ধর্মীয় হিসাব মতে লূতের সময় থেকে ৭০০ বছর পরে এসব মিথ তৈরী হয়েছিল।

প্রকৃত সত্য জানার পরেও শুধু মাত্র কিছু মিথের উপর ভিত্তি করে সমকামী সম্প্রদায়ের উপর আযাব-গযবের ট্যাগ লাগিয়ে দিবেন না বলে সচেতন পাঠকের কাছে আশা করছি।

তাসনুভা ফেরদৌসী