একান্ত ভাবনাবাংলাদেশরাজনীতি

শুধু বাংলাদেশকে ভুলে গেলেই এই যাত্রায় হয়ত বেঁচে যেতে পারি

যে চলে যায় তার খুব সম্ভবত আর গল্প থাকেনা। সে গল্প নিজেই বয়ে বেড়ায় এক আদিম গ্লানি ফলে সেসব গল্প তেমন বলাও হয়ে ওঠেনা খুব করে। আমাদের এইসব মনে হতে থাকা কিংবা না হতে থাকা জীবনে এর কি কোন মূল্য রয়েছে আদৌ?

তাঁরা আর কোনদিন-ই ফিরে আসবেন না। যারা ধার্মিক তাঁরা বলবেন এই ছেলে-মেয়ে গুলো বেহেশত বা স্বর্গে গেছেন। যারা ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন, তাঁরাও দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলবেন “নেই”।

এটা একটা অসীম শূণ্যতার গল্প কিংবা উপাখ্যান। পিট সীগার কেন বলছিলেন বহুদিন আগে যে, where have all the flowers gone? পীট সীগারের এই প্রশ্নের উত্তর অন্তত আমার কাছে নেই।

গতকাল আমি মন্ত্রী শাহজান খানের একটি ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। তাঁকে দেখতে বানানো হয়েছিলো ড্রাকুলার মত। ঠোঁটের দুই দিকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। চোখ দুটো লাল। আমরা মানুষ হিসেবে একজন পিশাচকে যেভাবে কল্পনা করি সেটির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছিলাম।

এক পর্যায়ে মনে হোলো, কি লাভ তাতে? কি উদ্ধার হবে এতে করে? কেবল ব্যাক্তিগত রাগ ও ক্রোধের কিছুটা উপশম হওয়া ছাড়া?

একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আসলে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নেই। শোক মানুষকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে, মানুষও শোককে এডপ্ট করে নিয়েছে। সাময়িক যে যন্ত্রণার মধ্যে আমরা বসবাস করি সেটি ঠিক সে সময়ে অত্যন্ত খাঁটি হলেও এগুলো নতুন নতুন ঘটনার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

কাকে দোষ দেব বলেন? কারই বা খুঁত ধরব? আমাদের শোকের আয়ু কমতে কমতে যখন শূণ্য হয়ে উঠলো তখন আমরা বুঝলাম, আমাদের হারাবার কিছু নেই। ইনফ্যাক্ট আমাদের পাবারও কিছু নেই।

দিয়া বাসের চাকার নীচে চলে গেলো, আরো দু’জন চলে গেলো দিয়া’র সাথে। দেখুনতো ওই বাকী দুজনের নাম-ই মনে নেই!! গতকালের ঘটনা আজই নাম ভুলে গেলাম। টাইপিং এর এই পর্যায়ে মনে হোলো গুগোল করে দেখে নেই। কিন্তু ইচ্ছে হোলো না একদম। মনে হোলো আমার এই শোকশূন্য সময়টার সাথে প্রতারনা না করি। যা সত্য শুধু তাই বলি।

রাজীবের কথা ধরুন। ওই যে দুই বাসের চাপায় হাতটা ফেলে দিতে হলো। তারপর মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে ম’রে গেলো ছেলেটা। পত্রিকায় পড়েছিলাম তাঁর দুই ভাই রয়েছে। ছেলেবেলাতে রাজীব আর দুই-ভাই এদের তিনজনের বাবা ও মা মারা গেলে রাজীব অনেক কষ্ট করে এদের বড় ক’রে তোলে। খাদ্য দেয়, পোষাক দেয়, বাঁচিয়ে রাখে। সেই রাজীবও তো ম’রে গেলো। ঐ বাচ্চা দু’টির কি অবস্থা এখন, কেউ কি জেনেছি আর?

আবার সেইদিন হানিফ পরিবহনের একটা বাস থেকে এক তরুনকে বেঁধে ফেলে দিলো পানিতে। ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর মিলে। ছেলেটি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। বাসে করে যাচ্ছিলো মায়ের কাছে। বাথরুমে যাবে বলে বাস থেকে নামলো। আবার বাসে উঠবার সময় ছেলেটি আহত হোলো। তারপর এই আহত ছেলেটিকে নিয়ে ঝামেলা হবে ভেবে মেরে ফেল্লো ছেলেটিকে।

কি সুন্দর দেখতে ছেলেটি। ছেলেটির ছবি দেখে আমার এক অদ্ভুত কারনে প্রথমেই মনে হয়েছিলো, ও কি কাউকে ভালোবাসতো? কিংবা কেউ তাঁকে?

আমরা পত্রিকার পাতাতে এসব পড়ি আর কর্পূরের মত এগুলো এক সময় উড়ে চলে যায়। যাবেই তো! কয়লাখনির এম ডি বলেছেন ১ লক্ষ টন কয়লা উড়ে চলে গেছে। আর আমাদের যন্ত্রণা আর বিষাদ!!! এসব কি করে আমাদের ভেতরে পড়ে রইবে? এরা তো আরো হালকা আরো বর্ণহীন…

শেখ হাসিনাকে গাল দেয়া যায়। গাল দেয়া যায় ওবায়দুল কাদের নামের বালকটিকে। গাল উঠতে পারে মাল মুহিতের ঘাড়ে, গাল চলতে পারে মতিয়ার মুখের প’র। কিন্তু তারপর? তারপর কি?

তারপর কিছু না। তারপর অসীম শূন্যাত। বাবনা করিম গেয়েছিলো না এমন কিছু?

“একদিন আমি হেঁটে চলছি পথে একা…হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থমকে দেখি…চারিদিকে শুধু আঁধার…”

বাবনা একদিন একা চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন। আমাদের সাথে পার্থক্য হচ্ছে আমরা সম্মিলিত ভাবে হোঁচট খেয়ে পড়ে রয়েছি দীর্ঘদিন। দীর্ঘদিন মানে দীর্ঘদিন…

সবাই বলে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। সবাই বলে বাংলাদেশ আরো আগাবে। আরো সামনে যাবে। সবাই এমনই বলে।

আমি বলিনা কিংবা বলতে পারিনা। এই দেশের ইতিহাস পড়ে আমি এই সময়ের এক অর্বাচীন বালিকা তাশনুভা আটকে রয়েছি ইতিহাসের নানান গলি আর ঘুপচিতে।

বালক বললাম বলে হেসেছেন। তাই না?

এই দেশটা নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। এক বুক গাঁজা টেনে কিংবা প্যাথিড্রিন নিয়ে, মরফিন নিয়ে কিংবা ইয়াবা নিয়েীই দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়।

আমার এক বন্ধু আমাকে দেখলে প্রায়ই বলে, “গাঁজা খাবি?”। আমি বলি “গাঁজা খাইনি আগে। খেলে কি হয়?”

আমায় সে বলে, গাঁজা খেলে নাকি বহুদূর পর্যন্ত উড়ে চলে যাওয়া যায়। তারপর সে চলার পথে ভুলে থাকা যায় দুঃশাষন, দূর্নীতি, লুটপাট, খুন, হত্যা, ধর্ষন। নিজস্ব বেদনা, যন্ত্রণা আর হাহাকার।

ভুলে যেতে খুব ইচ্ছে করে। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে দিয়াকে। দিয়ার সাথে বাসের নীচে পড়া নাম ভুলে যাওয়া বাকীদের। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীরের প্রলাপ, ভুলে যেতে ইচ্ছে করে একরামুলের মেয়েদের, কর্ণফুলির পাশে নুরুল ইসলাম নুরুর গলিত আর মথিত লাশ, ভুলে যেতে ইচ্ছে করে রাজীব, ভুলে যেতে ইচ্ছে করে সাগর আর রুনি কিংবা তনু। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে শৈশব, কৈশোর আর গোটা সময়।

সব ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।

মনে হয় নিজের মাকে ভুলে যাই, বাবাকে ভুলে যাই। ভাই-বোন সব কিছু। ভুলে যাই সমস্ত স্মৃতি। এত এত যন্ত্রণা। এত এত কষ্ট। এত এতো থোক থোক রক্তের গল্প আর ভালো লাগেনা।

আর কিছু না হোক, শুধু চাই বাংলাদেশকে ভুলে যেতে। এর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্মৃতি ভুলে যেতে চাই। এর মানুষ। এর রাজনীতিবিদদের।

শুধু বাংলাদেশকে ভুলে গেলেই এই যাত্রায় হয়ত বেঁচে যেতে পারি…